কৌশিক সেন

মেঘজন্ম

কৌশিক সেন




সুন্দর হয়ে ওঠো আরেকটিবার

ব্রহ্ম থেকে ঝরে পরুক পরাগ

রক্ত থেকে খসে পড়ুক কলঙ্ক

মৃত্যু থেকে উপচে উঠুক শান্তি

নিবন্ধিত যাকিছু, সকলই অমর

হোক আজন্মের জবানীতে!


ও সুখ, এসো স্তম্ভনে ভরে তুলি

এই নৃশংস পুরুষকার! শ্বেতপাথরের

আস্তাবল থেকে লাগামহীন ছেড়ে 

রাখি রঙিন ঘোড়াটিকে। দুর্বলতা

বলে যদি কিছু লেখা থাকে এই

হতভাগ্য অভিধানে, এইতো সময়,

তাকে নিশ্চিহ্ন করার!


তোমাকে অদেয় কিছুই নেই এই

ঘন অন্ধকারে। এই শ্যামলী দিন,

অলোকসামান্যা নারীর মত আকাশ,

যেখানে কষ্টিপাথরে খোদিত থাকে

অনামিকা রাক্ষসীনাম, সকলই শেকড়

ছিঁড়ে প্রোথিত করেছি তোমারই 

অনুর্বর মৃত্তিকায়। বুঝে নিও সব!


লক্ষহীরায় ভরে গেছে এই অস্থাবর

জনপদ।  আলাপে, অপলাপে

সুখে-সংকীর্তনে জেগে ওঠে

সুপ্রাচীন চর্যাগীতি।  লালিত স্বপ্নের

আহরণে ক্লান্ত হয়ে আমাদের

পূর্বপুরুষেরা যখন আশ্রয় নিয়েছিল

অনন্ত ঊর্মিমালায়, ঠিক তখনই

সূর্যসম্ভবা হয়ে উঠেছিলে তুমি। যাকিছু

আরক্তিম, সবটাই আঁচলে বেঁধে 

ফিরে গিয়েছিলে দূরের গঞ্জগাঁয়ে!


এমন করেও যে ভাবতে হবে, জানতামনা

কোনোদিন। পিশাচসিদ্ধা যোগিনীর ত্রিশুল

থেকে একমুঠো সিঁদুর নিয়ে এক দৌড়ে

ছুঁয়ে আসতে হবে ভোরের আকাশ। অর্বুদে 

ভরে দিতে হবে আজন্মের শেকড়। চেনা গাছ

চেনা ঝোপঝাড়, আদিম সরীসৃপ পৃথিবীর

নিভৃত গন্ধ বয়ে আনতে হবে এই উন্মত্ত

ধরিত্রীতে!


মুক্তি নেই এই মেঘজন্ম থেকে।

ভেড়ার পালের মত এই বাহারি জীবনের

কাছে শরৎ রচনাবলীর প্রথম ও দ্বিতীয় 

খণ্ডটি রেখে গেলাম। পড়তে পড়তে 

বিকেল নামবে এই বৃদ্ধা ধরণীতে।  

কাঠগোলাপের গন্ধে মম করবে

ধ্বস্ত উপত্যকা। যাকে তুমি, আমি,

আমরা সকলে মৃত্যু বলে জানি, 

দেখো, তাকে নিছকই ভোরের সুখস্বপ্ন

ছাড়া কিছুই মনে হবেনা আর!



মকরসংক্রান্তি


মৃত শ্বাসযন্ত্রের ওপর আমাদের কোনো দায় নেই। যেমন শাসনযন্ত্রের ওপর।

জোঁকে রক্ত শুষে নিয়ে গেলে পাতার ফাঁকে লেগে থাকেনা একফোঁটা সমুদ্ররস।

হেঁয়ালির মত ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে মানময়ী জ্যোৎস্না, শুক্লা প্রতিপদের তিথি।

যতক্ষণ না মাটির চতুর্দিকে তীব্র ষড়যন্ত্র ঘনীভূত হয়, শীতপোশাকের পশম খুঁটে 

খেয়ে যায় অবান্তর কীটপতঙ্গ, ততক্ষণ আমরা অপেক্ষা করে থাকি নিভৃত  উৎসবে।

তামাম শ্বসনযন্ত্রে জমিয়ে রাখি ভেঙে যাওয়া মাটির প্রদীপ, জ্বলে যাওয়া সলতে আর

পোড়া মাটির আঘ্রাণ। যদি বলো, এতো উপলক্ষ্য মাত্র, তবে বলি, মূর্তিমান বিভীষিকার

ভেতর একবার অন্তত পথ চেয়ে দেখো, পাও কিনা!  শান্ত সারসের ঠিকানায় যদি

একটি ছিন্নপত্র পাঠিয়ে থাকো, তাও বলবো, যথেষ্ট নয়, এ যথেষ্ট নয়। জীবনকে যদি

গোলাপি ফুস্ফুসের আশ্লেষে ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে এক নিঃশ্বাসে গিলে ফেলতে

হবে তেমন তেমন করে লেখা হেমলকে ভেজানো কাব্যপোন্যাস।  মাটির মানুষিকে

পশুভাব দিয়ে যদি হীন করতে চাও, তবে শ্বাসনালীতে যেন কোনো প্রাণবায়ু অবশিষ্ট

না থাকে।  ঝিল্লিতে যেন জমা হয় অন্ধকারের চেয়েও গাঢ় কোনো বেদনা, অমাবস্যার

থেকেও ঘন কোনো রাত।  ঝিরিঝিরি তটিনী যেন টগবগ ফুটতে থাকে এক লহমায়!


আমাদের কান্না, আমাদের শোক। গভীর নেশার মত ভ্রম কোনোদিন সূর্যোদয় দেখেনি।

সূর্যস্তবও।  সারারত ধরে আঁচলে জড়ো করে গেছে মেরুপ্রদেশের ভালোবাসা।  মালা 

গাঁথতে গাঁথতে পলাশ ফুলের রঙ লেগেছে পশ্চিম আকাশে।  প্রশস্ত আঙিনায় জমা 

হয়েছে কবেকার লাশ। শ্বাসযন্ত্রে জমা হয়েছে কটুগন্ধ।  অনেকটা ঠিক শাসনযন্ত্রের

মতোই! বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে টপাটপ মাটিতে পড়েছে কাকভোরের টুকরো আলোরা।  

ভেবেছিলাম কুড়িয়ে রাখবো, পারিনি।  তার আগেই আগুন লেগেছে বাঁদিকের বারান্দায়।

জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে সমস্ত অলিন্দ, নিলয়।  তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে গেছে দুপুরচাতকের।

আমাদের বৃন্দগানের সকল পঙক্তি ভস্মীভূত হয়েছে কোনো এক অজানা পারমাণবিক 

বিস্ফোরণে।


গানের পরতে পরতে মাঘকুয়াশার শীত। শ্বাসের ঘনত্বে কোনো সঙ্কেতশব্দ ভেসে আসেনা।

নাসারন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে শীতল কালাচ। যদিও শীতঘুমে, তবুও কবে জানিনা, খোলস ছেড়ে 

গেছে কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায়।  গত বসন্ত থেকে আর ঘুম আসেনা তাই।  শুধু কবিতা আসে,

ঘিনঘিনে, চিটচিটে, বরফশীতল সব কবিতা।  একটাও বেচতে পারিনি বাজারে। শ্বসনতন্ত্রে

যেকয়টি কাঞ্চনফুল ফুটেছিল, একটাও বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। মরে গেছে। ঝরে গেছে

মকরসংক্রান্তির গন্ধে গন্ধে। এই পৃথিবীতে আর কিছুই বাসযোগ্য নেই আর!



পাঠকের মতামতঃ